প্রায় সব দেশে, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সব সংস্কৃতিতেই নববর্ষ উদযাপনের প্রথা প্রচলিত আছে। অবশ্য উদ্যাপনের রীতি-প্রকৃতি ও পদ্ধতি-প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে, তবু সর্বক্ষেত্রেই একটি মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে। তা হলো নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরানো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি । টেনিসন যখন বলেন :
রিং আউট দি ওল্ড, রিং ইন দি নিউ, রিং, হ্যাপি বেলস্ এ্যাক্রস দি স্নো : দি ইয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো, রিং আউট দি ফল্স, রিং ইন দি ট্রু ॥
তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করি । কবি রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন :
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক ॥ যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
যাক পুরাতন স্মৃতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক ॥
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
রসের আবেশরাশি
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা । শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ ৷
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক ।।
তখন তার মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করি। একজন বলেছেন, পয়লা জানুয়ারিকে উদ্দেশ্য করে, আরেকজন লিখেছেন পয়লা বৈশাখকে মনের মধ্যে রেখে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবটি উভয়ক্ষেত্রেই এক।
পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অনন্য উৎসব, তার অন্যতম জাতীয় উৎসব। এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও গৌরবমণ্ডিত। অবশ্য কালের যাত্রাপথ ধরে এর উদযাপন রীতিতে নানা পালাবদল ঘটেছে, বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন মাত্রিকতা অর্জন করেছে। সুদূর অতীতে এর সঙ্গে কৃষি সমাজের যোগসূত্র ছিল অবিচ্ছেদ্য। প্রাচীন কৃষিসমাজের শীতকালীন নির্জীবতার পর নবজীবনের আবির্ভাবের ধারণার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টি সম্পর্কিত ছিল, একথা ভাবা অসঙ্গত নয় । এক সময় গ্রাম- নগর নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিষ্টান হোক, বাংলা নববর্ষের উৎসবে সোৎসাহে যোগ দিত। পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব, মেলা ও প্রদর্শনী মিলে সারা বছরের অন্যান্য দিনগুলি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে এই দিনটি গৌরবমণ্ডিত হয়ে উঠত। সাড়ে তিনশ' বছরেরও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের জনগণের নওরোজ বলে উল্লেখ করেছেন । অবশ্য তারও বহু শতবর্ষ আগে থেকে বাংলার মানুষ নানাভাবে এই দিনটি পালন করে আসছে।
কিন্তু পালা বদলের কথা বলছিলাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোর এক পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এদেশের শোষিত ও পরশাসিত জনগণের চিত্তে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল, যদিও সে সময়কার মুসলিম মানসে এর কোনো গভীর বা প্রত্যক্ষ অভিঘাত লক্ষ করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে অবলম্বন করে তার জাতীয়তাবাদী অনুষঙ্গের সঙ্গে যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা যুক্ত হয়েছিল, একটু লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে তৎকালীন নয়া উপনিবেশবাদী, ক্ষীণদৃষ্টি, ধর্মান্ধ, পাকিস্তানি শাসকবর্গ যে মনোভাব প্রদর্শন করেন তা একইসঙ্গে কৌতূহলোদ্দীপক ও ন্যক্কারজনক । তখন এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে একটি প্রতিবাদী মনোভাব নিয়ে পরম উৎসাহ ভরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনাকে তুলে ধরেছে, তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ঘোষণা করেছে, তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশেও এই দিনটি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা ও মিঠাই বিতরণের অনুষ্ঠান তো আছেই। তার পাশাপাশি আছে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী ও মেলার আসর, সঙ্গীতানুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, আলোচনা সভা, বক্তৃতা- ভাষণ ইত্যাদি। তবে যে গ্রামবাংলা ছিল পয়লা বৈশাখের আনন্দানুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র, আজ অর্থনৈতিক কারণে শহরে, বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকায়, পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে এখন যে চাঞ্চল্য ও আনন্দ-উৎসব দেখা যায় তা নিতান্তই মেকি একথা বলা যাবে না, কিন্তু তার মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নাগরিকের বুর্জোয়া বিলাস ও ফ্যাশনের একটি বড়ো অংশ কাজ করছে সেকথা মানতেই হবে ।পয়লা বৈশাখকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের আন্তরসত্তার সঙ্গে এর রাখিবন্ধনকে আবার নতুন করে বাঁধতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমাদের আজ বাংলা নববর্ষের মধ্যে সচেতনভাবে নতুন মাত্রিকতা যোগ করতে হবে। বাংলা নববর্ষের উৎসব যে বিশেষভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত, শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের উৎসব, এর একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র যে অত্যন্ত তাৎপর্যময় আজ সেকথাটা আবার জোরের সঙ্গে বলা চাই। নিজেকে একবার একজন হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে ভেবে দেখুন, তাহলেই এর শভিনিস্টিক দিকটি বুঝতে পারবেন। অথচ এ অঞ্চলের ঐতিহ্য তো তা নয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া শক্তির সামনে স্বাধীন বাঙলার সূর্য ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সিরাজদ্দৌলা শেষবারের মতো লড়াই করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান উভয়কে। আমাদের ঐতিহ্য তো মীর মদন ও মোহন লালের, তিতুমীর ও মঙ্গল পাণ্ডের, গোবিন্দ দেব ও মুনীর চৌধুরীর । তবে কেন এখন এরকম ঘটছে? পাকিস্তানি আমলের ধর্মের নামে নৃশংসতার ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অপরাজেয় শক্তি ও মহিমায় পূর্ণ করুক, এই হোক আমাদের শুভ কামনা। জয় পয়লা বৈশাখ।
বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান হালখাতা। এছাড়া বৈশাখী মেলা, ঘোড়দৌড়, আনন্দ আয়োজন, বিভিন্ন লোকমেলার আয়োজন করে সাধারণ মানুষ এ উৎসবকে প্রাণে ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে যে এতটা প্রাণের আবেগে এবং গভীর ভালোবাসা। নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হয় তার কারণ পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার বাঙালিকে এ-উৎসব পালন করতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, এটা পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী। ফলে পূর্ব বাংলার বাঙালি ফুঁসে উঠেছে। সোচ্চার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদে ।
কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা আবদুল হালিম চৌধুরী ও মাতা আফিয়া বেগম। কবীর চৌধুরী ১৯৩৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা ও ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন করেন। চাকরি ও অধ্যাপনা করে তাঁর কর্মজীবন শেষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি শিক্ষাবিদ প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা : ছয় সঙ্গী, প্রাচীন ইংরেজি কাব্য সাহিত্য, আধুনিক মার্কিন সাহিত্য, সাহিত্য কোষ, স্তদাল থেকে প্রস্ত, পুশকিন ও অন্যান্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ চর্চা, ছোটদের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, ছবি কথা সুর, শহিদের প্রতীক্ষায়। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। কবীর চৌধুরী ২০১১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন।
নির্জীবতা- প্রাণশূন্যতা, এখানে ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী সময়। সোৎসাহ- উৎসাহের সঙ্গে, আগ্রহ সহকারে। গৌরবমণ্ডিত- মহিমাময়, মর্যাদাপূর্ণ।
নওরোজ- নতুন দিন। পারস্য দেশের নিয়ম অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম দিন। স্বাদেশিকতা—নিজের দেশের প্রতি প্রেম বোঝানো হয়েছে।
জাতীয়তা— স্বজাতিচেতনা সংক্রান্ত। প্রত্যক্ষ অভিঘাত- সরাসরি আঘাত, এখানে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে। সাম্রাজ্যবাদ- পররাজ্যের ওপর কর্তৃত্ববিস্তাররূপ রাজনৈতিক কূটকৌশল।
উপনিবেশ— জীবিকা নির্বাহের জন্য অথবা স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য দলবদ্ধভাবে বিদেশে যে বসতি স্থাপন করা হয়। ক্ষীণদৃষ্টি— সংকীর্ণ দৃষ্টি।
কৌতূহলোদ্দীপক— যাতে কোনো অজানা বিষয় জানার আগ্রহ বাড়ে। ন্যক্কারজনক— অত্যন্ত নিন্দনীয়, ধিক্কারজনক। হালখাতা— নতুন বছরের হিসাব-নিকাশের জন্য নতুন খাতা খোলার উৎসব।
বুর্জোয়া বিলাস - মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের শখ। রাখিবন্ধন— শ্রাবণ পূর্ণিমায় প্রিয়জনের ডান হাতে মঙ্গল কামনায় রাখি বেঁধে দেওয়ার উৎসব।
শভিনিস্টিক- আত্মগৌরব মতবাদী ।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত (২০০৮) বাংলাদেশের উৎসব : নববর্ষ নামক গ্রন্থ থেকে রচনাটি সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মোবারক হোসেন। বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উৎসব। কৃষি-নির্ভর এদেশে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ধারণা তৈরি হয়। এ উৎসব শুধু হিন্দুর বা মুসলমানদের কিংবা বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের নয়-এ উৎসব সমগ্র বাঙালির। এ উৎসব শুধু বিত্তবান, মধ্যবিত্ত বা দীন দরিদ্র কৃষকের নয়- এ উৎসব বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী সমস্ত মানুষের। ধর্মীয় সংকীর্ণতার বৃত্ত অতিক্রম করে বাংলা নববর্ষ উৎসব আজ আমাদের জাতীয় চৈতন্যের ধারক- এ অভিমত ব্যক্ত করে লেখক প্রবন্ধটিতে পয়লা বৈশাখের জয়গান গেয়েছেন। ‘পয়লা বৈশাখ' প্রবন্ধটি বাংলাদেশের উৎসব ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেবার পাশাপাশি ধর্ম ও সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ জাতীয় ঐক্যবোধে মিলিত হবার শিক্ষা দেয়।
উদ্দীপকটি পড় ও প্রশ্নের উত্তর দাও :
“বাংলার হিন্দু
বাংলার বৌদ্ধ বাংলার খ্রিষ্টান
বাংলার মুসলমান
আমরা সবাই বাঙালি'
Read more